হোস্টেড নাকি সেলফ হোস্টেড ইকমার্স সল্যুশন আপনার জন্য তুলনামূলক ভাল বা সুবিধার হবে সেটা আপনার বিজনেসের ধরণ, সেটআপ, বাজেট ইত্যাদি বুঝে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অনলাইনে ব্যবসার খুবই প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান নিজের ব্র্যান্ডের একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট। এখন কথা হচ্ছে কিভাবে বানাবেন নিজের ই-কমার্স ওয়েবসাইট বা অনলাইন স্টোর? বর্তমানে বিশ্বে মূলত দুই ধরণের অনলাইন শপের সল্যুশন রয়েছে। একটি হচ্ছে সেলফ হোস্টেড সল্যুশন এবং অন্যটি হোস্টেড সল্যুশন। অনেকের কাছেই হয়তো এই দুই ধরণের সল্যুশন কি, কিভাবে কাজ করে এবং এদের মধ্যে মূল পার্থক্যগুলো পরিষ্কার না। তাই প্রথমে আসুন সেলফ হোস্টেড আর হোস্টেড সল্যুশন কি এবং খুব সহজে কিভাবে বোঝা যায় তেমন একটি উদাহরণ দেখে নিই।

সেলফ হোস্টেড ইকমার্স

আমাদের দেশে যে ইকমার্স সাইটগুলো দেখা যায় তার বেশিরভাগই সেলফ হোস্টেড সল্যুশন। এক্ষেত্রে ওপেনসোর্স যে ইকমার্স সল্যুশন বা সিএমএসগুলো রয়েছে সেগুলোর একটি ডাউনলোড করে নিজে কোনো হোস্টিং স্পেসে হোস্ট করে অনলাইন শপ চালাতে হয়। এখানে শুরুতে সফটওয়্যার কেনার ঝামেলা নেই কিন্তু অনলাইন শপ সেটআপ, সিকিউরিটি ও মেইনটেনেন্সের এর পুরো দায়িত্বই থাকে নিজের। সেলফ হোস্টেড সল্যুশন এর মধ্যে Magento, WooCommerce, Opencart, osCommerce, Spree Commerce ইত্যাদি বেশি জনপ্রিয়।

হোস্টেড ইকমার্স

হোস্টেড ইকমার্স সল্যুশন ওপেনসোর্স বা ফ্রি সফটওয়্যার প্রোডাক্ট না। এখানে ইকমার্স সল্যুশন তৈরী, হোস্টিং, সিকিউরিটি এবং মেইনটেনেন্সের কাজ করে থাকে একটি কোম্পানি যাদের প্লাটফর্ম বা সল্যুশন আপনি ব্যবহার করছেন। এই মডেলকে বলা হয় সফটওয়্যার অ্যাজ অ্যা সার্ভিস (SaaS)। এখানে আপনি সম্পূর্ণ অনলাইন শপের সার্ভিস মাসিক/বার্ষিক সাবস্ক্রিপশন ফি এর বিনিময়ে পেতে পারেন। জনপ্রিয় হোস্টেড ইকমার্স প্লাটফর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে Shopify, BigCommerce, Volution, 3dCart এর মতো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিগুলো। আমাদের দেশের জন্য উপযোগী এই ধরণের একমাত্র হোস্টেড ইকমার্স প্লাটফর্ম হলো Storrea

ধরুন যাতায়াতের জন্য আপনি নিজে প্রাইভেট কার কিনবেন নাকি উবারের প্রাইভেট কার ব্যবহার করবেন। প্রথম অপশন প্রাইভেট কার কিনতেই শুরুতে আপনার বড় একটি খরচ হবে। নিজের প্রাইভেট কারে আপনি যখন যেখানে খুশি, সুবিধামত সময়ে, পছন্দসই রাউট দিয়ে যেতে পারবেন। আবার ড্রাইভারের বেতন, নিজের কারের মেইনটেনেন্সের চিন্তা এবং খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। গন্তব্য পৌছানোর পুরো দায়িত্বই আপনার নিজের, ব্যাপারটা সেলফ হোস্টেড সল্যুশনের মত। অপরদিকে উবারের কারের জন্য আপনাকে উবারের সার্ভিস নিতে হবে, উবারের পলিসি অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে, অনেক সময় আপনার পূর্ণাঙ্গ সুবিধাজনক নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার বড় খরচ নেই, তবে যখনই উবার ব্যবহার করবেন তখনই নির্দিষ্ট ভাড়া গুনতে হবে। উবারের কারের ড্রাইভার এবং মেইনটেনেন্সের ঝামেলা আপনাকে নিতে হবে না। এক্ষেত্রে আপনার গন্তব্যে পৌছানোর দায়িত্ব উবারের, যা হোস্টেড সল্যুশনের মত কাজ করে।

তাহলে বুঝতেই পারছেন দুই ধরণের সল্যুশনের যে কোন একটি দিয়েই আপনার কাজ চলবে। সুবিধা অসুবিধা দুই ধরণের সল্যুশনেই আছে। এখন কোনটা আপনার জন্য তুলনামূলক ভাল বা সুবিধার হবে সেটা আপনার বিজনেসের ধরণ, সেটআপ, বাজেট ইত্যাদি বুঝে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনলাইন স্টোর তৈরী, অনলাইন স্টোর সাজানো বা কাস্টমাইজেশন এবং অনলাইন স্টোর মেইনটেনেন্স এই তিনটি স্টেজে দুই ধরণের সল্যুশনের সুবিধা অসুবিধাগুলো চলুন একটু দেখে নিই।

অনলাইন উদ্যোক্তার সাফল্যগাঁথা

অনলাইন স্টোর তৈরী

সেলফ হোস্টেড:

এই পদ্ধতিতে অনলাইন শপ তৈরির জন্য প্রথমে আপনাকে সফটওয়্যার ডাউনলোড করে কোনো হোস্টিং সার্ভিস প্রোভাইডার থেকে হোস্টিং কিনে সেখানে সফটওয়্যারটি ইনস্টল করতে হবে। নিজের যদি পর্যাপ্ত টেকনিক্যাল নলেজ না থাকে তাহলে একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার বা কোনো কোম্পানি এর সাহায্য নিতে হবে এজন্য। সফটওয়্যার ইনস্টল হয়ে গেলে দরকারি প্লাগিন ইনস্টল করে এবং থিম কাস্টোমাইজ করে চালু করে ফেলতে পারবেন আপনার অনলাইন শপ। অনলাইনেও প্রচুর রিসোর্স পাবেন কিভাবে অনলাইন স্টোর তৈরি করবেন, যতেষ্ঠ আগ্রহ এবং সময় থাকলে নিজেও সেভাবে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

এখানে সুবিধা হলো পুরো সিস্টেমের কন্ট্রোল এবং মালিকানা থাকছে আপনার হাতে। ডেভেলপার দিয়ে চাইলে আপনার বিজনেস রিকোয়ার্মেন্ট অনুযায়ী কাস্টম ফিচার ও মডিউলও বানিয়ে নিতে পারবেন। তবে এই সুবিধাগুলো পেতে শুরুতেই আপনার বেশ বড় অংকের একটা টাকা খরচ হয়ে যাবে (মানসম্মত ইকমার্স সাইটের জন্য নূন্যতম ৪০-৫০ হাজার টাকাও লাগতে পারে)। সবকিছু সেটআপ এবং কাস্টোমাইজ করে সাইট চালু করতে বেশ খানিকটা সময়ও হাতে রাখতে হবে। বাৎসরিক হোস্টিং এবং মেইনটেনেন্স এবং এককালীন কিংবা অন-ডিমান্ড ডেভেলপমেন্টের খরচাদি মাথায় রেখেই সাইট তৈরির সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

start-online-store by storrea

হোস্টেড:

সেলফ হোস্টেড সল্যুশন দিয়ে অনলাইন শপ তৈরির তুলনায় হোস্টেড প্লাটফর্ম দিয়ে শুরু খুবই সহজ, বলতে গেলে শুরু করার জন্য আপফ্রন্ট কোনো খরচ নেই, মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়েই শুরু করে দেয়া যায়। শপ তৈরির ব্যাপারটা অনেকটা ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল খোলার মতোই। প্লাটফর্মের সাইটে গিয়ে নিজের স্টোরের নাম, ইমেইল এড্রেস দিয়ে মুহূর্তেই তৈরি করে ফেলা যায় একটি অনলাইন শপ। তারপর অ্যাডমিন প্যানেল থেকে থিম আর প্রয়োজনীয় সেটিংস ঠিক করে নিলেই হয়ে গেল। প্রয়োজনে টিউটোরিয়াল দেখে নিলেই পারবেন। পেমেন্ট গেটওয়ে, ডেলিভারি চ্যানেল এগুলো ইন্টিগ্রেটেডই থাকে হোস্টেড প্লাটফর্মে। এই ধরণের প্লাটফর্মগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে কোনো টেকনিকাল নলেজ ছাড়াই যে কেউ অপারেট করতে পারে। এছাড়া হোস্টেড সল্যুশনগুলোর আরেকটি বিশেষ সুবিধা হলো দুই তিন সপ্তাহের ফ্রি ট্রায়াল ব্যবহারের সুযোগ থাকে যাতে ব্যবহারকারী সব কিছু জেনেবুঝে নিতে পারেন।

তবে সেটআপ খুব আয়েশী হলেও কিছু অসুবিধাও আছে বৈকি! এখানে চাইলেই নতুন ফিচার বানিয়ে নিতে পারবেন না। প্লাটফর্ম আপনার সাবস্ক্রিপশন অনুযায়ী যেই ফিচারগুলো দিবে সেগুলো দিয়েই কাজ করতে হবে। অনেক প্লাটফর্ম কাস্টম ফিচার তৈরী করে দেয় তবে সেটা তাদের প্রোডাক্ট রোডম্যাপ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। তাই অ্যাডমিন প্যানেল রিলেটেড ফিচার ডেভেলাপ করা একটু সময় সাপেক্ষ, কাস্টম চার্জও লাগতে পারে। তাই এধরণের প্লাটফর্মের থেকে সার্ভিস নেবার আগে কি কি ফিচার আছে বা কাস্টমাইজেশনের সুযোগ কতটুকু বিস্তারিত জেনে নেয়া উচিত হবে।

অনলাইন ষ্টোর কাস্টমাইজশন

সেলফ হোস্টেড:

আপনার যদি অনেক কাস্টম রিকোয়ার্মেন্ট থাকে তাহলে সেলফ হোস্টেড সল্যুশন তুলনামূলক সুবিধাজনক হবে। এখানে সবকিছুতে আপনার কন্ট্রোল রয়েছে, তাই চাইলেই ডেভেলপারের মাধ্যমে যে কোনো পার্ট হতে পারে তা চেকআউট সিস্টেম, কাস্টম প্রোডাক্ট ফিল্টার, নতুন প্রোডাক্ট রিলেটেড এট্রিবিউট অ্যাড করা ইত্যাদি করতে পারবেন সহজেই। অনেক সময় এই ধরণের কাস্টম ফিচার আপনার কাস্টোমারদের ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স দিবে যা আপনার বিজনেসের স্বকীয়তা এবং সুনাম বাড়াতে পারে। তবে সবার জন্য সুবিধাজনক হবে এমনটা নয়। এজন্য আপনার পর্যাপ্ত বাজেট এবং দীর্ঘমেয়াদী বিজনেস ভিশন থাকা খুবই জরুরী। কারণ সাইটের কাস্টমাইজেশনের পিছনে কত বিনিয়োগ করছেন তার রিটার্ণ পাওয়ার হিসাব আপনাকেই করতে হবে।

online store customization by storrea

হোস্টেড:

হোস্টেড সিস্টেমও কাস্টমাইজ করা যায়, তবে সেটার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সাইটের এর থিম খুব সহজেই কাস্টমাইজ করা যায়। এই ধরণের অনেক প্লাটফর্মে থিম এডিটর রয়েছে যেটা দিয়ে ডিপ লেভেলে কাস্টমাইজ করা সম্ভব। অনেক সময় চেকআউট পেইজে কি কি অপশন থাকবে, অর্ডার প্লেসমেন্ট এবং প্রসেসিং ফ্লো কি হবে সেটাও অ্যাডমিন প্যানেল থেকে কাস্টমাইজ করা যায়। সাধারণত কমন যে ফিচারগুলো একটি অনলাইন স্টোর চালাতে দরকার হয় সেগুলো বেশ সহজেই কাস্টোমাইজ করা সম্ভব। একদম ইউনিক রিকোয়ার্মেন্ট যেমন ধরুন আপনি পণ্য কিস্তিতে বিক্রি করবেন বা অমুক পার্সেন্ট পেমেন্ট অ্যাডভান্স নিবেন ইত্যাদির জন্য শুধু  সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানির পক্ষেই তা আপনার জন্য তৈরী করে দেওয়া সম্ভব। আপনার নিজের করার অপশন নেই যতক্ষণ না প্রোভাইডার শুধুমাত্র আপনার জন্য বা ইনজেনারেল প্লাটফর্মে ফিচারটি যুক্ত করছে। আর প্লাটফর্মগুলোতে প্যাকেজভেদে বিভিন্ন কমন অ্যাডভান্স ফিচার অফার করে, আপনি প্যাকেজ আপগ্রেড করে অনায়াশেই সেই ফিচার ব্যবহার করতে পারবেন। তাই আপনার বিজনেসের যদি খুব বেশি ইউনিক ফিচার না থাকে তাহলে হয়তো হোস্টেড সল্যুশন দিয়েই আপনার দিব্যি চলে যাবে।

অনলাইন স্টোর মেইনটেনেন্স

সেলফ হোস্টেড:

বুঝতেই পারছেন সেলফ হোস্টেড সল্যুশনের মালিক যেহেতু আপনি নিজেই, সেটির মেইনটেনেন্সের কাজও আপনাকেই করতে হবে। ২৪/৭ সার্ভিস চালু রাখা, প্রোমোশনের সময় একসাথে অনেক ভিজিটর আসলে যাতে সাইট ডাউন বা স্লো না হয়ে যায়, কেউ যাতে সিস্টেম হ্যাক করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সার্ভার সিকিউরিটি আপনাকেই বা আপনার হোস্টিং প্রোভাইডারকে ম্যানেজ করতে হবে। মেইনটেনেন্সের ঝামেলা কিছুটা কমাতে পারেন যদি ক্লাউডে হোস্ট করেন। হোস্টিংয়ের নিয়মিত মেইনটেনেন্সের বিষয়গুলা তখন ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানি দেখবে, সেজন্য বাড়তি কিছু খরচতো আছেই। সবমিলিয়ে ঝামেলাহীন সাইটের পারফর্মেন্স এবং মেইনটেনেন্সের জন্যও আপনেকে একটা বাজেট রাখতে হবে।

maintenance by storrea

হোস্টেড:

হোস্টেড প্লাটফর্মে সাইট মেইনটেনেন্সের ঝামেলা নেই বললেই চলে। কারণ হোস্টিং সম্পর্কিত সব ধরণের নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তার বিষয়গুলো এই ধরণের প্লাটফর্মের সার্ভিসেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আধুনিক সব প্লাটফর্মই ক্লাউড হোস্টিং ব্যবহার করে থাকে, তাই ধরে নিতে পারেন সাবস্ক্রিপশন অনুযায়ী সর্বোত্তম মেইনটেনেন্স সেবাই পাচ্ছেন। হোস্টেড সল্যুশন ব্যবহার করলে সার্ভিস সংক্রান্ত আপনার একটিই চিন্তা; তা হলো সাবস্ক্রিপশন চালিয়ে যাওয়া। SaaS মডেল অনুযায়ীই আপনি যতদিন সাবস্ক্রিপশন চালিয়ে যাবেন প্লাটফর্ম আপনার সাইটের মেইনটেনেন্স করতে বাধ্য। সাবস্ক্রিপশন বন্ধ করলে আপনার সাইটও অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবে।

পরিশেষ

দুই ধরণের সল্যুশনেরই তুলনামূলক বিশ্লেষণের চেষ্টা করলাম। সেলফ হোস্টেড সল্যুশন যেমন আপনাকে দিবে সাইটের পূর্ণ মালিকানা এবং কাস্টমাইজেশনের স্বাধীনতা, তেমনি থাকছে খরচ এবং মেইনটেনেন্সের চিন্তা। অপরদিকে হোস্টেড সল্যুশনে ইউনিক কাস্টমাইজেশনের সীমাবদ্ধতা আছে, সাইটের চালানোর পুরো ব্যাপারটিই আপনি প্লাটফর্মের সার্ভিস আকারে নিচ্ছেন, তবে মেইনটেনেন্সের ঝামেলা নেই, খরচে কিছুটা সাশ্রয়ী। আপনার জন্য সুবিধাজনক সল্যুশনটি বেঁছে নিন। সবার জন্য শুভকামনা।

হোস্টেড সল্যুশন ট্রাই করতে চাই

(Visited 1,422 times, 1 visits today)
10

Comments