যে কোনো দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার প্রথম শর্ত হল আইনগত বৈধতা। আর এ বৈধতার প্রাথমিক ধাপ হল ট্রেড লাইসেন্স। বৈধভাবে যেকোনো ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিজের একটি ট্রেড লাইসেন্স থাকা আবশ্যক। নিচে আমরা কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তরভিত্তিক বিভাগ সাজিয়েছি যেখানে ট্রেড লাইসেন্স সংক্রান্ত বিস্তারিত সব তথ্য আপনি পেয়ে যাবেন।

প্রশ্ন ১ঃ কোন কোন ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স লাগে?

যে কোনো ব্যবসা করতে হলে আগে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ১৯৮৬ সালের মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ট্যাক্সেশন বিধিমালার ৪৪(১) বিধি অনুসারে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইলে অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। বলতে গেলে সব ব্যবসা ও স্বাধীন পেশার জন্য ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। এমনকি ফুটপাতে বসে যিনি ফল কিংবা টঙ এর দোকানে চা বিক্রি করবেন তারও লাইসেন্স দরকার। তাই যেই ব্যবসাই করুন না কেন ট্রেড লাইসেন্স অবশ্যই করতে হবে।

প্রশ্ন ২ঃ আইনি বৈধতার  বাইরে ট্রেড লাইসেন্স আর কি কি কাজে লাগে? 

একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নানা কাজে লাগে এই লাইসেন্স। যেমন-

  • ব্যাংক ঋণ নিতে।
  • ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব খুলতে। মনে রাখবেন ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব দিয়ে আপনি ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারবেন না।
  • ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ব্যবসায়ীর বিদেশে যেতে হলে।
  • কোনো ব্যবসায়িক এসোসিয়েশন এর সদস্য হতে হলে।
  • এছাড়া ভ্যাট ও টিন এর জন্যও ট্রেড লাইসেন্স অপরিহার্য।

প্রশ্ন ৩ঃ  ট্রেড লাইসেন্স করতে কি কি লাগে ? 

  • ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্থানটি নিজের হলে সিটি করপোরেশনের হালনাগাদ করের রশিদ এবং ভাড়ায় হলে ভাড়ার চুক্তিনামা বা রশিদ আবেদনপত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হবে।
  • আবেদনপত্রের সঙ্গে তিন কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা দাখিল করতে হবে।
  • জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি
  • TIN সার্টিফিকেট
  • বাড়ির ইউটিলিটি বিলের কপি
  • যে বাড়ীতে ব্যবসায় পরিচালনা করছেন তার হোল্ডিং ট্যাক্স হালনাগাদ করণের রশিদ
  • প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি লিমিটেড হলে মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস ও সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন দিতে হবে। আর পার্টনারশিপ ব্যবসার ক্ষেত্রে পার্টনারশিপ ডিডের কপি দিতে হবে।
  • যদি কারখানা দিতে চান; প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান, কারখানা বা কোম্পানির পার্শ্ববর্তী অবস্থান বা স্থাপনার নকশাসহ ওই স্থাপনার মালিকের অনাপত্তিনামাও দাখিল করতে হবে।
  • এসব ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন কাগজপত্র জমা দিতে হয়। যেমন-
    • শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ওপরের সব দলিলের সঙ্গে পরিবেশসংক্রান্ত অনাপত্তিপত্র, প্রতিষ্ঠানের অবস্থান চিহ্নিত মানচিত্র ও অগ্নিনির্বাপণ প্রস্তুতিসংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র দিতে হবে।
    • ক্লিনিক বা ব্যক্তিগত হাসপাতালের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমোদন, ছাপাখানা ও আবাসিক হোটেলের ক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনারের অনুমতি
    • রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য মানবসম্পদ রপ্তানি ব্যুরো কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স, অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স
    • ট্রাভেল এজেন্সির ক্ষেত্রে সিভিল এ্যাভিয়েশনের অনুমতিপত্র
    • সিএনজি স্টেশন বা দাহ্য পদার্থের ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তর বা ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র

প্রশ্ন ৪ঃ  ট্রেড লাইসেন্স করতে কোথায় যাবো

  • আপনি সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, সিটি কর্পোরেশন অথবা পৌরসভায় গিয়ে ট্রেড লাইসেন্স বানাতে পারেন।
  •  ঢাকায় কিভাবে পাবো?
    • ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) তার নাগরিকদের সেবা দেওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনকে কতগুলো অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনের পাঁচটি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পাঁচটি অঞ্চল রয়েছে। আপনার প্রতিষ্ঠানটি যে অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, ওই অঞ্চলের অফিস থেকেই লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে।
    • ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য দুটি ভিন্ন ধরনের ফরম রয়েছে। ফর্মগুলো ‘আই ফর্ম’ ও ‘কে ফর্ম’ নামে চিহ্নিত প্রতিটি ফর্মের দাম ১০ টাকা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যদি ছোট বা সাধারণ হয়, তবে ‘ফর্ম আই’ আর বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘কে ফর্ম’ নিতে হয়।

আজকাল অনেক কনসালটেন্সি ফার্ম আছে যারা নির্দিস্ট সার্ভিস চার্জ এর বিনিময়ে এসব কাজ করে দিয়ে থাকে। নিজে ঝামেলা পোহাতে না চাইলে এরকম কোনো ফার্মের হেল্প নিতে পারেন।

প্রশ্ন ৫ঃ ট্রেড লাইসেন্স করতে কত টাকা লাগবে?

লাইসেন্স ফি ব্যবসার ধরনের ওপর নির্ভর করে কমবেশি হতে পারে। এই ফি সংশ্লিষ্ট অফিসে রসিদের মাধ্যমে জমা দিতে হবে। প্রোপাইটরশিপ বা পার্টনারশিপ ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্স ফি সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আকার বা ধরন অনুযায়ী এই ফি নির্ধারণ করা হয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এর অধীনে ৫শ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত রেট আছে। সফটওয়ার, আইটি বা জেনারেল সাপ্লায়ার হিসেবে কম বেশী ৫ হাজার। সাথে রয়েছে ভ্যাট। আবার লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানির পেইড আপ ক্যাপিটালের উপর ভিত্তি করে লাইসেন্স ফি নির্ধারিত হয়। বিভিন্ন ব্যবসার ধরণ অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্স করার ফি এর বিস্তারিত দেখুন এখানে

প্রশ্ন ৬ঃ ট্রেড লাইসেন্স করতে কত দিন লাগবে?

একটি লাইসেন্স পেতে ৩-৭ দিন সময় লাগতে পারে।

প্রশ্ন ৭ঃ একটি ট্রেড লাইসেন্স এর মেয়াদ কতদিন? মেয়াদ পূর্ণ হলে কি করতে হবে?

একটি ট্রেড লাইসেন্স এর মেয়াদ এক অর্থ বছর। অর্থাৎ জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু হয়ে পরের বছরের জুন মাসের ৩১ তারিখ শেষ হবে। শেষ হলে নবায়ন ফি দিয়ে আপনাকে লাইসেন্স নবায়ন করে নিতে পারবেন। আপনি যখনি ট্রেড লাইসেন্স করান না কেন জুলাইতে আবার নবায়ন ফি দিতে হবে।

লাইসেন্স নবায়ন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। এর মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আবেদন করতে হবে। এ জন্য আগের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কর কর্মকর্তা নবায়নকৃত লাইসেন্স প্রদান করবেন। লাইসেন্স নবায়ন ফি নতুন লাইসেন্স ফির সমান। এই ফি আগের মতোই ফরমে উল্লিখিত ব্যাংকে জমা দিতে হবে।

যদি সময়মত লাইসেন্স নবায়ন না করা হয় তাহলে আপনার ব্যবসার আইনগত বৈধতায় প্রশ্ন থেকেই যায়।

প্রশ্ন ৮ঃ ট্রেড লাইসেন্স করার পর কোনো প্রয়োজনে নাম ঠিকানা পরিবর্তন করা যায় কি?

ফি প্রদান ও এফিডেভিটের মাধ্যমে যে কোনো তথ্য পরিবর্তন করা যায়। তবে এক অর্থবছরে ব্যবসায়িক ঠিকানা DNCC থেকে DSCC এ বা বিপরীতে পরিবর্তন হলে ঠিকানা পরিবর্তন করা যায় না। সেক্ষেত্রে নতুন অর্থবছরে নতুন ঠিকানা সহ নতুন লাইসেন্স করে নিতে হবে। যদি একই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ঠিকানা পরিবর্তিত হয় তাহলে যে কোন সময়ই তা পরিবর্তন করা যাবে।

প্রশ্ন ৯ঃ একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে কি বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে ব্যবসা করা যায় ?

এক ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে কাছাকাছি ক্যাটাগরির ভিন্ন ব্যবসা করা যায়, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্সে ভিন্ন ক্যাটাগরি যোগ করতে হবে এবং সেই ক্যাটাগরির লাইসেন্স ফি যোগ করতে হবে। যেমন আপনি IT ক্যাটাগরি দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে পরবর্তীতে Software ক্যাটাগরি যোগ করতে পারবেন ফি প্রদান সাপেক্ষে। বর্তমানে ই-কমার্স ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স  IT বা Software ক্যাটাগরি দিয়ে করা হয়। তবে কাছাকাছি ক্যাটাগরির ব্যবসা না হলে অবশ্যই সেই ব্যবসার আলাদা ট্রেড লাইসেন্স করে নিতে হবে।

একটি ট্রেড লাইসেন্স এর অধীনে বিভিন্ন রকমের পণ্য বিক্রি করা যায়। সেক্ষেত্রে ক্যাটাগরি হবে জেনারেল সাপ্লায়ার।

প্রশ্ন ১০ঃ একটি ট্রেড লাইসেন্স কয় জায়গায় ব্যবহার করা যায়?

একটি ট্রেড লাইসেন্স একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করতে পারবেন না। একটি ট্রেড লাইসেন্স শুধু একজন ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তা ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ যে ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তার নামে ট্রেড লাইসেন্সটি করা হয়েছে এটি শুধু তার জন্যই প্রযোজ্য। এটা কোনোভাবেই হস্তান্তরযোগ্য নয়।

প্রশ্ন ১১ঃ  ই- কমার্স ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স এর জন্য কি করতে হবে?

আমাদের ব্যবসায়িক তালিকায় এখনো ই কমার্স যুক্ত হয়নি। শুধুমাত্র এই ক্যাটাগরিতে এখনো ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করা হয়না। তবে IT অথবা Software ক্যাটাগরিতে লাইসেন্স নেয়া যেতে পারে। এজন্য IT বা Software এর লাইসেন্স ফি ৫০০০ টাকা এবং অন্যান্য খরচ যেমন সাইনবোর্ড ট্যাক্স, নতুন বই খরচ, ১৫% ভ্যাট সহ ৭ হাজার টাকার মত খরচ পরে।

প্রশ্ন ১২ঃ আমি ঢাকায় থাকিনা কিন্তু আমার পণ্য ঢাকায় বিক্রি হয়। সেক্ষেত্রে আমার ট্রেড লাইসেন্স কোথা থেকে করালে ভালো হয়? 

যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো ব্যবসার আইনগত বৈধতার জন্য ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন। লাইসেন্সটা থাকলে বিপদে আপদে কাজে লাগবে।যেখানে আপনার অফিস বা ব্যবসার ঠিকানা শুধু সেখানেই ট্রেড লাইসেন্স নেবেন। তবে ঢাকায় যদি আরেকটা অফিস নেন। তখন এখানে আরেকটা ট্রেড লাইসেন্স এর প্রশ্ন আসবে। কিন্তু ব্যবসা করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স কোনো বাঁধা নয়। গ্রামে কিন্তু খুব অল্প টাকা দিয়েও ট্রেড লাইসেন্স করা যায়।

প্রশ্ন ১৩ঃ লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেতে পারে কি? 

মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ তথ্য দিলে, লাইসেন্সে উল্লিখিত শর্তাবলি এবং সিটি করপোরেশনের আইন ও বিধি মেনে না চললে লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। এ ছাড়া লাইসেন্স গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। তবে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে গ্রহীতাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হবে।

এই ব্লগের সংযুক্ত তথ্যাদি সরকারী প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেকোন সরকারী সিদ্ধান্তের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজনের কারণে এই তথ্যগুলো অকার্যকর বিবেচিত হতে পারে।

প্রয়োজনীয় লিংক ঃ

 

 

শুরু করুন নিজের একটি অনলাইন ব্যবসা

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

(Visited 9,850 times, 1 visits today)
3

Comments