অবশেষে ইন্টারনেট Meme এক্সপার্টরা একটু জিরোতে পারেন। এবারের একাডেমী অ্যাওয়ার্ডস নিয়ে প্রত্যাশার পারদটা যেন শুধু একটি পুরস্কারকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছিল। গোটা দুনিয়া একটি পুরস্কারের জন্যেই চাতক পাখির মতন বসে ছিল। সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত পুরস্কারের নাম “Oscar“। অবশেষে গোটা দুনিয়ার ভক্ত সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ করে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও ষষ্ঠবারের মত নমিনেশন পেয়ে প্রথমবারের মত বগলদাবা করলেন চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার “Academy Awards Best Actor for 2016“। শেষ হল ডি ক্যাপ্রিওর ২০ বছরের অধীর অপেক্ষা।

 

ইন্টারনেট এর দুষ্প্রাপ্যতার সেই দিনগুলোতে যখন ছিল না টরেন্ট কিংবা লাইভ স্ট্রিমিং সাইটের রমরমা পসরা তখন দোকান থেকে ভাড়া করে আনা ভিডিও ক্যাসেটই ছিল একমাত্র সমাধান। বিশ্বের ক্ষুদ্র এক প্রান্ত বাংলাদেশেও এসে পড়লো মহাবিশ্বের এক তরঙ্গের ঢেউ। ৯৭-৯৮ এর সেই সময়ে সবার মুখে মুখে ফিরছে একটি নাম “Titanic“। সত্যি কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত বক্স অফিস কাঁপানো সেই ভালোবাসার ব্যথাভরা কাহিনী দেখার জন্যে সকলের কি আকুল প্রতীক্ষা। নীল চোখের জ্যাকের ভূমিকায় অভিনয় করা ডি ক্যাপ্রিও ঘরে বাইরে ছেলে বুড়ো সবার কাছেই তখন এক পরিচিত নাম।

 

টাইটানিক ছিল ডি ক্যাপ্রিওর ক্যারিয়ারের প্রথম বড় অর্জন। সেই সময় সর্বকালের সবচেয়ে বেশী উপার্জন করা মুভির তালিকায় টাইটানিক দখল করে নেয় শীর্ষস্থান। মোটামুটিভাবে আন্তর্জাতিক হার্টথ্রবে পরিণত হন ডি ক্যাপ্রিও। স্বর্ণকেশী চেহারা, কটা চোখের রমণীমোহন শিশুসুলভ চেহারা তাকে রাতারাতি গোটা দুনিয়ায় খ্যাতির চুড়ায় নিয়ে যায়। এরপর একের পর এক বৈচিত্র্যধর্মী চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ডি ক্যাপ্রিও নিজেকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। তার উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে The Man in the Iron Mask, Catch Me if You Can, The Aviator, The Departed, Blood Diamond, Inception, Django Unchained, Wolf Of Wall Street প্রভৃতি। এর মধ্যে ৫ বার মনোনীত হয়েছিলেন অস্কারের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার “Best Performance by an Actor in a Leading Role” এর জন্যে। অবশেষে ৬ষ্ঠ বারে তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। “The Revenant” চলচ্চিত্রের জন্যে জিতে নিলেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। বিশ্বজোড়া তার ভক্ত অনুরাগীরা এইবার খুব করে চাইছিলেন ডি ক্যাপ্রিও যেন এইবার তার অধরা সম্মানটি পেতে পারেন। নিরাশ হতে হয়নি তাদেরকে।
The Revenant চলচ্চিত্রের দৃশ্যপট আবর্তিত হয়েছে ১৮২০ সালের এক পশম ব্যবসায়ীর প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের গল্প নিয়ে। এই চলচ্চিত্রের জন্যে তারা গিয়েছিলেন দক্ষিণ মেরুতে। টানা ৭ মাস দীর্ঘ পরিশ্রমের পর তাদের শুটিং শেষ হয়। একজন জাত অভিনেতা ডি ক্যাপ্রিও এই চলচ্চিত্রের জন্য বেশ ত্যাগ স্বীকার করেছেন বলতে হবে। রাতে শুয়েছেন পশুর মৃতদেহের উপরে। খালি গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বরফ জমা নদীতে, খেয়েছেন বাইসনের কাঁচা মাংস। শিল্পের জন্য ডি ক্যাপ্রিওর এ আত্মনিবেদন চলচ্চিত্র শিল্পের সবারই জানা অনেক দিন ধরে।

একজন মানবতাবাদী ও পরিবেশবাদী বলে পরিচিত ডি ক্যাপ্রিওর মানব সমাজের উন্নয়নের জন্য অঙ্গীকারগুলো ফুটে উঠেছে তার অস্কার জয়ের বক্তৃতায়। বৈশ্বিক উষ্ণতার ভয়াবহ রূপ তুলে ধরে সবার জন্যে সচেতনতার ডাক দিয়েছেন তিনি। পাঠকদের জন্যে নিচে তার অস্কার বক্তৃতার ভিডিও দিয়ে দেওয়া হল। আর সাথে বোনাস হিসেবে তার বক্তৃতার অনুবাদও।

 

 

ডি ক্যাপ্রিওর অস্কার বক্তৃতার অনুবাদ

The Revenant মূলত মানুষের সাথে পৃথিবীর প্রাকৃতিক জগতের সম্পর্কের গল্প। সেই পৃথিবীর গল্প যা কিনা ২০১৫ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের পুরো প্রোডাকশনকে যেতে হয়েছে দক্ষিণের সুদূরতম মেরুতে শুধু বরফ এবং তুষারপাত এর অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য। জলবায়ু পরিবর্তন কোন মিথ নয়। এটি সত্যিই ঘটছে। আর এটি ঘটছে এই মুহুর্তেই। এই মুহুর্তে এটিই সবচেয়ে বড় হুমকি আমাদের জন্যে। আমাদের গোটা মানবজাতির জন্যেই। আর এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সবাইকে সমষ্টিবদ্ধ ভাবেই কাজ করতে হবে। আমাদের সবার সব রকম আলস্য ঝেড়ে এখনি মাঠে নেমে পড়তে হবে। আমাদের সমর্থন দিয়ে যেতে হবে সেইসব রাজনীতিবিদদেরকে যারা বড় বড় কর্পোরেট আর দূষণকারী কোম্পানির হয়ে কথা বলেন না; যারা কথা বলেন সমগ্র মানবতা নিয়ে। যারা কথা বলেন পৃথিবীর সব বিপন্ন আদিবাসীদের নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে যে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হবে,আমাদের সন্তানদের সন্তানরা যারা আক্রান্ত হবে, লোভের রাজনীতি দিয়ে যাদের কে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করা হচ্ছে তাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাই এই অসাধারণ রাতটির জন্যে।

 

এই পৃথিবীটাকে আপনার জন্মগত কোন অধিকার ভাববেন না। এই রাতকেও আমি আমার জন্মগত কোন অধিকার মনে করছিনা। সবাইকে আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ।

ডি ক্যাপ্রিওর অস্কার প্রাপ্তি যেন শুধু এক ব্যক্তিগত অর্জন নয়। গোটা পুরষ্কারই মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে তার প্রাপ্তিতে। অনেক অনেক অভিনন্দন লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও। একই সাথে আমাদেরকেও দেখিয়ে দিলেন কোন বড় অর্জনের জন্যে ধৈর্য্য ও অধ্যবসায় এর আসলে কোন বিকল্প নেই। স্বীকৃতি হয়তো অনেক সময় দেরিতে আসবে। কিন্তু নিজের কাজে একাগ্র সাধনায় মত্ত থাকলে সাফল্য আসবেই।

(Visited 472 times, 1 visits today)
3

Comments