পলিবিধৌত পদ্মাপাড়ের এই যুবকের গল্পটা আর সাধারণ দশটা মধ্যবিত্ত বাংলাদেশী তরুণের মতই। হতে পারত ছাপোষা জীবনই তার নিয়তি। কিন্তু অদম্য সাহস ও উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন তাকে আর সাধারণ দশটা তরুণের জীবন যাপন করতে দেয়না। পদ্মার বালুময় পাড় থেকে উঠে আসা এই যুবক তাই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেন সারা বিশ্বের। আমাদের আজকের গল্পের নায়ক স্যামসন এইচ চৌধুরী। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কোম্পানি “স্কয়ার গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ” এর প্রতিষ্ঠাতা।

১৭ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন কাউকে না জানিয়েই। ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমান বোম্বেতে( অধুনা মুম্বাই)। নতুন নতুন প্রযুক্তি জানার ও ব্যবহার করার ইচ্ছা তার জন্মগত। যোগ দিলেন ১৯৪৩ সালে ইন্ডিয়ান রয়্যাল নেভীতে। পোস্টিং হল সিগন্যাল ইউনিট কোরে। কিন্তু বেঁকে বসলেন স্যামসন। তিনি যোগ দিতে চান রাডার ইউনিট এ। অবাধ্য হওয়ার সাজাও তাকে পেতে হয় বৈকি। ৫ দিনের হাজতবাস শেষে কমান্ডিং অফিসার যখন তার কাছে আবার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলেন, একরোখা স্যামসন অনড় তার সিদ্ধান্তে। রাডার ইউনিটেই জয়েন করবেন তিনি। অগত্যা তার জেদের কাছে হার মানতে হল অফিসারকে। 

তিন বছর চাকুরী করে বিদ্রোহ করে বসলেন বৃটিশরাজের বিরুদ্ধে। জেল খেটে চাকুরী থেকে বহিষ্কার হলেন। ফিরে এলেন বাড়িতে। যোগ দিলেন পোস্টাল বিভাগে। এখানেও তার প্রতিবাদী সত্ত্বা। দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ অফিসারকে উত্তম মাধ্যম করে হয়ে গেলেন ট্রান্সফার। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন যার চোখে তার কি এই ছাপোষা চাকুরে জীবনে মন বসে?  চাকুরী জীবন ভাল না লাগায় তা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন ১৯৫২ তে। তবে বেকার বসে থাকেন নি, পিতার “হোসেন ফার্মেসি” তে কাজ করা শুরু করে দিয়েছিলেন একই বছরে।

ব্যবসা চলছিলো ভালোই; কিন্তু উচ্চাভিলাষী স্যামসন এর যেন তাতেও মন ভরছিলোনা। বড় কিছুর স্বপ্নে খোঁজ নিতে লাগলেন নতুন কি শুরু করা যায়। ফার্মেসীর ব্যাপার স্যাপার যখন মোটামুটি আয়ত্বে, তখন ভাবলেন ঔষধ ফ্যাক্টরিই দিবেন। বাবার কাছে ধার নিলেন ৫০০০ টাকা। নাম দিলেন “Esons”।  বাবার নামে “Eakub and sons”।

নিজের জীবনের প্রথম এই উদ্যোগে তিনি নিজেই মালিক, নিজেই শ্রমিক, নিজেই ডিস্ট্রিবিউটর, নিজেই আবার মার্কেটিং অফিসার। পাশে পেয়েছেন যোগ্য সহধর্মিণী আনিতাকে।

কিন্তু আরও বড় কিছুর স্বপ্নে বিভোর তরুণ স্যামসন এর মন। বন্ধু ডঃ কাজী হারুনুর রশিদ কে প্রস্তাব দিলেন একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি দাঁড় করানোর। আরও দুই বন্ধু ডঃ পিকে সাহা, রাধা বিনোদ রায় কে নিয়ে চারজনে মিলে শুরু করলেন পার্টনারশিপে “Square Pharmaceuticals“।

 

চার বন্ধু যেন বর্গক্ষেত্রের চারটি বাহু। আর বর্গক্ষেত্রের জ্যামিতিক সূত্র মেনে চার বন্ধুই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই হল আজকের “Square Pharmaceuticals” এর নামকরণের ইতিহাস।

সততা, মেধা আর পরিশ্রমের সমন্বয়ে কোম্পানি কে সামনে এগিয়ে নিতে খুব বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৬৪ সালে  “Square”  প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশের বাইরে থেকেও অর্ডার আসছিল নিয়মিত। ১৯৬৪ সালে পেয়ে গেলেন বড় এক সুযোগ। জনসন এন্ড জনসন ইন্টারন্যাশনাল এর কাছে পেলেন তাদের ওষুধ প্রস্তুতের লাইসেন্স। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি স্কয়ারকে। এরপর শুধুই সামনে এগিয়ে চলা। ১৯৮২ সালে সরকার এর ওষুধনীতিটা এলো আশির্বাদ হয়ে। সরকার বিদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল এর ১৭০০ ওষুধ এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার পর স্কয়ার এর জন্যে এক বিরাট বাজার উন্মুক্ত হয়ে গেল। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশি প্রথম কোন ব্র্যান্ড হিসেবে বিদেশে ওষুধ রপ্তানি শুরু করে স্কয়ার ফার্মা।

এরপর শুধু সম্প্রসারণের পালা। ১৯৮৮ সালে স্কয়ার টয়লেট্রিজ, ১৯৯৪ সালে স্কয়ার টেক্সটাইল। একে একে স্কয়ার স্পিনিং মিল, স্কয়ার নিট ফেব্রিক্স, স্কয়ার কনজ্যুমার প্রোডাক্ট এর প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে সর্বজনবিদিত স্যামসন এইচ চৌধুরী বছরের পর বছর সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছেন। একজন মডেল ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি অনুকরণীয়  একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত সবখানে।

এই হলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী এবং তাঁর কোম্পানি স্কয়ার। সব বড় কিছুর শুরুটা ছোট হয়। শুরু করাটাই চ্যালেঞ্জ। পথের সন্ধান পথে নামলেই পাওয়া যায়।

(Visited 519 times, 1 visits today)
0

Comments