নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে ব্যবসার গতিপ্রকৃতি। আগের দিনে মানুষ বাজারে, মার্কেটে একটি দোকান নিয়ে ব্যবসা করত। কারণ কাস্টমাররা যেত সেখানেই। শহুরে ব্যস্ততা আর ইন্টারনেট সহজলভ্যতার এই সময়ে কাস্টমাররা আসলে কোথায় ভিড় জমান সেটা আমাদের কারও অজানা নয়। ঘরে বসে দুই ক্লিকে বাজার সদাই সেরে ফেলার এক নতুন বাস্তবতা আমাদের আজকের বাংলাদেশে। তাই অনেকেই শুরু করছেন অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে উপার্জনের একটি বাড়তি পথ। ইকমার্স ব্যবসা তাই আজকের তরুণের পছন্দের একটি অপশন।

ই-কমার্স ব্যবসার শুরুতে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তাগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মার্কেটপ্লেস কিংবা ফেসবুককে পণ্য বিক্রির মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে কাস্টমারের আনাগোনা, আসতে থাকে অর্ডার; বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিধি। আপনি কি আজীবন এভাবেই বিক্রি করে আপনার ব্যবসা চালানোর কথা ভাবছেন? এই ব্যবসাকে নিজের স্বাধীন পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন কি আপনার মনে একটুও উঁকি দেয়না?

 

অনলাইন ব্যবসার কোন না কোন সময় আপনি অনুভব করবেন যে আপনার দরকার একটি নিজের ইকমার্স ওয়েবসাইট। কিংবা নিজের একটি অনলাইন স্টোর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কখন নিজের একটি অনলাইন স্টোর পরিচালনার কথা চিন্তা করবেন? কখন আপনার নিজের প্লাটফর্মে ব্যবসা করা উচিৎ তা বোঝার কিছু লক্ষণ নিচে দেখে নিতে পারেন।

 

যখন আপনি মাত্রাতিরিক্ত ফি/কমিশন দিচ্ছেন

যখন নিজের পণ্য বিক্রয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট বা প্লাটফর্ম থাকেনা, তখন আপনি পণ্য বিক্রয়ের জন্য মার্কেটপ্লেসের দ্বারস্থ হোন। যে কোন মার্কেটপ্লেস চলেই মূলত আপনার বিক্রি করা পণ্যের উপর নির্দিষ্ট ফি বা কমিশন ভোগ করে। যে পরিমান ফি বা কমিশন নিয়মিত আপনি মার্কেটপ্লেসকে দেন, তা যদি নিজের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন তাহলে কিন্তু আপনিই লাভবান হবেন। যখন আপনি ব্যবসা শুরু করেন তখন এই ৫-১০% কমিশন আপনার কাছে নগন্য মনে হতে পারে। কিন্তু আপনার ব্যবসা এবং পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে এই ক্ষুদ্র ৫-১০% কমিশনও একটি বড় অংকে পৌছায় যা কিনা পুরোটাই আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই যোগ হতে পারতো! নিজের একটি অনলাইন স্টোর তৈরী এবং সেখানে কাস্টমার ট্রাফিক সরিয়ে আনা শুরুতে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে ব্যবসায়িক পরিকল্পনার পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে আপনি শেষ পর্যন্ত লাভবানই হবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

চাই নিজের একটি ব্র্যান্ড ভ্যালু; নিজের স্বাধীনতা

একথা চিরসত্য যে আপনার ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য আপনাকে বিভিন্ন পন্থায় বিভিন্ন প্লাটফর্মে পণ্য বিক্রয় করতে হবে। শুধুমাত্র একটি প্লাটফর্ম, ধরুন আপনি যদি শুধু মার্কেটপ্লেসেই পণ্য বিক্রয় করে থাকেন তবে তা এই প্রতিযোগীতামূলক বাজারে এক ধরণের বোকামিই হবে। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি রেভিনিউ বাড়ানোর জন্য নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু প্রতিষ্ঠা করা অন্য যে কোন প্লাটফর্মে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! মার্কেটপ্লেসে পণ্য বিক্রয়ের পাশাপাশি আপনি যদি নিজের অনলাইন শপ চালু করতে পারেন তা আপনার পণ্য বিক্রয়ের শুধু একটি নতুন মাধ্যমই তৈরী করবে না, বরং আপনি নিজস্ব একটি ব্র্যান্ড তৈরী করতে পারবেন। সেখানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন থাকবে আপনার কাছে, আপনি ইচ্ছা স্বাধীনমত আপনার সেলস পরিকল্পনা চালনা করতে পারবেন। সোজা বাংলায় বললে আপনার ব্যবসায় অন্য কেউ নাক গলানোর সুযোগ পাবে না!

কমে যাচ্ছে বিক্রি; আপনার ব্র্যান্ডের নাম ভুলে যাচ্ছে ক্রেতা

আপনি যখন মার্কেটপ্লেসে পণ্য বিক্রয় করেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর আপনার পণ্য বিক্রয়ের হার ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কারণ একই ধরণের পণ্যের রকমারী সমারোহে অনেকসময় আপনার পণ্য সঠিক ভাবে হাইলাইটেড হয় না, মার্কেটপ্লেস স্বভাবতই নতুন পণ্যের বিপননে মনযোগ দেয়, কাস্টমারগণ বেশিরভাগ সময়ই বিভ্রান্ত থাকেন। যখনই মার্কেটপ্লেসে বিক্রয়ের হার কমতে শুরু করে তখনই আপনি নিজের প্লাটফর্ম তৈরীর কাজ শুরু করতে পারেন। যখনই আপনি মার্কেটপ্লেসে নিজের পণ্যের একটি ভাল চাহিদা তৈরী করতে পারবেন, তখনই নিজের অনলাইন স্টোরে তা বিক্রয় শুরু করুন। আর নিজস্ব প্লাটফর্মে আপনি চাহিদা অনুযায়ী সেলস প্লান বানাতে এবং প্রয়োগ করতে পারবেন যা আপনার পণ্য বিক্রির হার নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দিবে।

ক্রেতা সাধারণই আপনার স্টোর খুঁজছে

নিজের একটি অনলাইন স্টোর কিন্তু আপনার ব্যবসায়িক পরিচয়, আপনার ব্যবসার ব্যাপ্তি এবং পরিপক্কতা তুলে ধরে। মার্কেটপ্লেসে পণ্য বিক্রয় করলে আপনার ব্র্যান্ড আইডেনটিটি হারায়, আপনার প্রতিটি পণ্যের পেছনে যে ব্যবসায়িক শ্রম ও মেধা আছে তা কিন্তু ক্রেতা সাধারণের কাছে অজানা থেকে যায়। যখন কেউ আপনাকে প্রশ্ন করবে আপনার পণ্য অনলাইনে কোথায় পাবে, তার উত্তরে আপনি যদি কোন মার্কেটপ্লেসের ঠিকানা দেন, সেটি আসলে খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা; কারণ ক্রেতা মারকেটপ্লেসে আপনার পন্য খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যাবেন; উৎসাহ হারাবেন। অনলাইন জগতে আপনার ব্যবসায়িক অস্তিত্বের প্রথম এবং প্রধান উপকরণ নিজের একটি অনলাইন স্টোর।

কাস্টমাইজেবল প্লাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা

ব্যবসার পরিধি যখন বাড়তে থাকবে তখন আপনি ক্রেতা সাধারণের চাহিদা মত কাস্টমাইজেবল প্লাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন যা মার্কেটপ্লেস বেশিরভাগ সময় দিতে পারেনা। মার্কেটপ্লেসে পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে আপনি কখনোই কাস্টমার ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারটি পাবেন না। নিজস্ব প্লাটফর্মে আপনি কাস্টমারদের ইমেইল অ্যাড্রেস, অর্ডার হিস্ট্রি, শপিং কার্ট অ্যাবান্ডনমেন্ট ইত্যাদি তথ্য জানতে পারবেন। এই তথ্যগুলো নতুন কাস্টমারকে পুনরায় পণ্য ক্রয়ে মোটিভেট করা বা কাস্টমার ধরে রাখার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দীর্ঘ মেয়াদী এবং কৌশলী ব্যবসার জন্য নিজের কাস্টমাইজেবল প্লাটফর্ম থাকা একান্ত দরকার।

1

যখন আপনি কোন এক্সক্লুসিভ পণ্য বিক্রয় করছেন

আমরা যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করি দেখবো যে বিভিন্ন নামিদামী ব্র্যান্ডের এক্সক্লুসিভ বা লাক্সারী পণ্য মার্কেটপ্লেসে দেখিনা। কারণটা খুবই সহজ, এই ধরণের পণ্য বিক্রেতা যত্রতত্র প্রদর্শন করতে চান না। ঠিক তেমনি আপনার যদি নিজস্ব কোন এক্সক্লুসিভ পণ্য, ভিন্নধর্মী কোন পণ্য থাকে আপনি অবশ্যই চাইবেন না সেটি মার্কেটপ্লেসে অন্যসব সাধারণ পণ্যের সাথে প্রদর্শিত হোক। বরং ক্রেতা সাধারণ যখন এই পণ্য খুঁজবেন, আপনি যেন গর্বভরে আপনার ব্র্যান্ড স্টোরের ঠিকানা তাদের বলতে পারেন সেভাবেই চিন্তা করুন। এই পণ্যটির সাথে আপনার যে ইমেজ এবং ইমোশন জড়িত আছে তা নিজের অনলাইন স্টোর ছাড়া মার্কেটপ্লেসে কখনোই বোঝা যাবে না! একইভাবে আপনি যদি পাইকারী ব্যবসায়ী হোন তাহলে নিজের ওয়েবসাইটেই তা তুলে ধরা শ্রেয়।

 

শেষকথা

নিজের একটি অনলাইন স্টোর আপনার ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে, নিজের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আপনি ক্রেতার সাথে আরো বেশী যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন। ছোট বা বড় যেই ব্যবসাই হোক না কেন নিজের ওয়েবসাইটের বিভিন্ন সেটিংস প্রয়োজন মাফিক কাস্টমাইজ করে ব্যবসার গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। অনলাইন কেনা বেচায় নিজস্ব ওয়েবসাইট তথা অনলাইন স্টোর থাকা মানেই কাস্টমারের কাছে আপনার ব্যবসার একটি নির্ভরতা এবং আস্থার জায়গা তৈরী হওয়া। নিজের প্লাটফর্মে শুধু পণ্য বিক্রয়ই নয়, আপনার ব্যবসার দর্শনটিও ক্রেতা সাধারণের কাছে খুব সহজেই তুলে ধরতে পারবেন। ক্রেতা-বিক্রেতার এই সুসম্পর্কের মাধ্যমে নিজের ব্যবসাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে তাই নিজস্ব অনলাইন স্টোরের কোন বিকল্প নেই!
 
 

(Visited 1,883 times, 1 visits today)
4

Comments